"জীবনটা মোকাবেলা করার জন্য, ভয়ে চুপসে থাকার জন্য নয়।"
------------------------------
আমার এক বান্ধবী হঠাৎ ফোন করলো আজ।তা, কমপক্ষে বছর খানেক পর হবে!
অপরিচিত নাম্বার দেখে একটু ইতস্তত করে ফোন টা রিসিভ করলাম।
ও পাশ থেকে কোন সম্বোধন কিংবা কুশল বিনিময়ের কোন বালাই নেই।ফোন রিসিভ করতেই ঠাস ঠাস করে কানের উপর কয়েকটা পড়লো,"তোরে থাপ্ড়াইয়া দাঁত খুলে ফেলবো। ফেসবুকে এসব কি লিখিস, হ্যা? "
আমি ঘটনার আকষ্মিকতায় হতবম্ভ। কে এত অধিকারের সাথে কথাগুলো বলছে তাও ভাবার কথা আমি ভুলে গেছি।সে যে কে, সেটাও জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছি না।
এদিকে, অন্য পাশ থেকে তিনি এক নাগারে বলে চলছেন,
"আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।তুই কি সেই? যে মৃত দেহেও জীবনের সন্ধান খোঁজে? তবে আজ কেন এতটা হতাশ? স্ট্রেঞ্জ!
তুই যে এতটা হতাশ,জিরো কনফিডেন্টেড হবি তা ভাবতেই পারছি না।"
এবার একটু দম নিলেন তিনি।আর আমিও সুযোগ পেলাম একটু ভেবে দেখার আসলে তিনি কে!
"কিরে কথা বলিস না কেন? তোরে চাপড়াইয়া কিন্তু সোজা করে ফেলবো। "
আমার ভাবার আর সময় নাই।কেন জানি মনে হচ্ছে,উত্তর না দিলে সত্যি সত্যি বোধহয় কপালে দুঃখ আছে।তাই সম্বোধন এড়িয়ে বললাম,"না মানে,নিজেকে নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে আছি।তাই ভেতরের কিছু কথা নিজের অজান্তেই বের হয়ে যাচ্ছে! "
ও পাশ থেকে বান্ধবী বলল,"দূর.. কি যা তা ভাবিস! B positive man.Everything is a part of living. Take these as simple as u can."
ও আমাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে, আর আমি মিলাতে চেষ্টা করছি সে কে! বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম, হায়রে! এত সেই টিনা! ২০০৮ এ যে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে আত্মহত্যার মত দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েছিলো ।প্রাইমারি থেকে কলেজে যে সেরাদের সেরা হয়েও এইচ এস সি তে চরম ফলাফল বিপর্যয়ে হতাশ ছিলো ।তারপর কত দিন-রাত ওকে বুঝিয়েছি তার ঠিক নেই! দু'জনের জীবনের চরম মুহুর্ত গুলো শেয়ার করে সেদিন জীবন থেকে হালকা হয়েছিলাম।সামনে এগুনোর পথ ধরে আমিই ওকে চলতে শিখিয়েছিলাম ভবিষ্যতের পথে। তারপর ও গেছে ওর পথে আর আমি আমার।
মাঝখানে প্রায় ৬ টি বছর কেটে গেছে।পাল্টে গেছে জীবনের লেনদেন,বদলে গেছে হিসেব। কিন্তু সাত বছর পর হঠাৎ করে উল্কা পিন্ডের মত উদয় হয়ে ও যে আমাকে নতুন করে পথ দেখিয়ে দেবে তা কখনোই ভাবিনি।
ও কথা বলেই চলেছে। সেসব কথা নয়,উপদেশ।আমি মনযোগী ছাত্রের মত শুনে চলেছি। হ্যা,হু কিচ্ছু নেই।
বেশ কিছুক্ষণ পর ও বলল,"কি রে,বুঝেছিস, কি বললাম? "
আমি ওকে বললাম, "তুই কেমন আছিস? ভালো আছিস তো? "
"ওহ! সরি রে! দেখ, তোর স্ট্যাটাস পড়ে এত মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে,তুই কেমন আছিস তা জিজ্ঞাসা করতেও ভুলে গেছি? আমি ভালো, তুই? "
-"যেমন দেখছিস।তেমনি আছি। আগে যেমন ছিলাম সেরকমই আছি,শুধু মাঝখানের সময়টা বদলে গেছে।
কত বছর হলো বলত? "
আমি কিছুটা শুকনো গলায় ওকে জিজ্ঞাস করলাম।
ও একটু পেছনে ফিরে গিয়ে বলল,"Its about six years. তাই না? লাষ্ট তোর সাথে কথা হয়েছে এডমিশনের পর।তারপর তো তুই হাওয়া হয়ে ছিলি।তোর আগের নাম্বার বন্ধ। কত ট্রাই করেছি!
কিন্তু গত ছয় মাস ধরে তোকে ফেসবুকে পেয়েছি। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিলাম,কিন্তু তুই তো এখনো আমাকে ঝুলায়ে রাখছিস! তোর ফেসবুকে দেয়া নাম্বারে কম করে হলেও দিনে দু বার ট্রাই করি।কিন্তু ওই যে, তুই হাওয়া হয়ে আছিস! তোকে মেসেজ করলেও কোন রিপ্লাই দিস না।ইচ্ছা করে ... । "
আমি বললাম, "কি ইচ্ছা করে? থাপড়াইয়া দাঁত খুলে ফেলার? "
ও বলল,"হু।তুই তো জানিস,আমি কারাতে ব্লাক বেল্ট। সো, তোর দাঁত খুলতে খুব বেশি পরিশ্রম হবে না! হা হা হা। "
ওর কথা শুনে আমি না হেসে পারলাম না।
সেই সাথে সাত বছর আগে ওর অনুপ্রেরণায়য় কারাত শিখতে যাওয়ার দিনগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমি দু একটা কাতা শিখে মাঝ পথেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখন ওত পরিশ্রম সহ্য হয়নি।কিন্তু ও ধরে ছিলো । মাঝে মাঝে কোন ছেলে কে কারাত ক্লাসে কিভাবে কাত করেছে সেসব বলে বলে আমাকে ঝারি মারতো,হাসাহাসি করতাম ।
হা হা হা।সেই বাঘিনী কন্যাই কিনা আবার আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো দু দুইবার । শেষ বার ও এতটাই হতাশ আর জীবন বিতৃষ্ণায় ভুগতো যে,ওকে ফেরানো ছিলো মৃতকে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া ।
সৃষ্টিকর্তার কৃপায় সেবার সে জীবন যুদ্ধে আরেকবার লড়াই করার শক্তি পেয়েছিলো । আমি শুধু ওর কষ্ট গুলো ভাগ করে নেয়ার দায়িত্ব পালন করেছিলাম।
আর সেদিন থেকে একটা কথা আমি বুঝেছি,"কেউ যখন অত্যধিক হতাশাগ্রস্থ আর আত্মহত্যা প্রবন হয়ে উঠে তখন তার কষ্ট গুলো সে কাউকে শেয়ার করতে চায়।চায়,কেউ তার কথাগুলো শুনুক।কেউ তার পাশে এসে দাঁড়াক।মাথায় হাত বুলিয়ে বলুক,সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি তো আছি।"
মুলত,কষ্ট গুলো যখন বুকের মধ্যে চাপা পরে থাকে, তখনই আত্মহত্যার মত দূর্ভাবনা মাথায় আসে।কিন্তু যখন কেউ তার কষ্ট গুলো কাউকে শেয়ার করতে পারে,কেউ যখন তার চাপা কষ্ট গুলো মনযোগ দিয়ে শোনে তখন হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তির কষ্ট গুলো হালকা হয়ে যায়।।জীবন সংগ্রামে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পায়। ঘুরে দাঁড়ায়।
টিনার বেলাতেও তাই হয়েছিলো। ও নিজেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে, স্বইচ্ছায়।
আমার দাঁত ভেঙে নেয়ার খুব একটা ইচ্ছে নেই।ওকে বললাম, "নে বাবা,আমারই ঘাট হয়েছে।দয়া করে মাফ কর।"
ও বলল,"তোকে সে জন্য মাফ করে দিলাম। কিন্তু ফেসবুকে যে উল্টা-পাল্টা লিখিস সেটার কি হবে,বল? "
"তুই হঠাৎ করে এতটা হতাশ হলি কিভাবে? প্রোবলেমটা কি? "
আমি একে একে গত ছয় বছরকে হাইলাইট করলাম । জীবনের এ বেলায় এসে আমার উপলব্ধি কি, তাও ওকে বুঝিয়ে বললাম । আর ও নিজেও কয়েকদিনের স্ট্যাটাস গুলো থেকে বেশ বুঝতে পেরেছে, আমি কি ভাবছি আর কি চাই।
অনেকক্ষণ ধরে কথা বলার পর ওর শেষ কথা হলো,
"যদি পারিস তবে আজ থেকে ছয়/সাত বছর পেছনে চলে যাস।আর টিনার জীবনের মোড় ঘুরানোর স্মৃতি গুলো একবার খুঁজে দেখিস।যদি না পারিস তবে, একটা কথা মনে রাখিস,"জীবনটা মোকাবেলা করার জন্য, ভয়ে চুপসে থাকার জন্য নয়।"