ক্যান?? (ছোট গল্প)
এমনিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। তার উপর বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা বৃষ্টিও হয়েছে। সব মিলিয়ে রাস্তার যা অবস্থা তাতে রাস্তায় পা দিলেই হাটু পর্যন্ত দেবে যায়। আর যদিও বা কেউ খুব প্রয়োজনে রাস্তায় বের হয় তবে অন্ধকারে দিক ঠিক না পেয়ে পাশের খাদে বা নালায় পরে যাওয়া অভূতপুর্ব কিছু না। এমন অবস্থায় ঘরের মধ্যে কাথা গায়ে শুয়ে থাকার চেয়ে উত্তম কিছু আর হয় না। রাত অবশ্য খুব একটা বেশি হয়েছে তা কিন্তু নয়,এই মোটামুটি আটটা কি নয়টা বাজে। কিন্তু এরকম অজপাড়াগাঁয়ে রাত আসে খুব তাড়াতাড়ি। গোধূলির রঙ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে । পাড়ার লোকেরাও তখন মুরগীর মত খোয়ারে উঠে।আবার মোরগ ডাকের সাথে সাথে সেই খোয়ার থেকে বেরও হয় । তাই রাত আটটা মানে এখানে অনেক রাত। মানুষ এখানে সময়ের হিসাবের জন্য দিনের সূর্য, রাতের চাঁদ বা তারাদের অনুসরণ করে। মোরগের ডাক জানিয়ে দেয় এখন সকাল। তখন মানুষগুলো ঘুম থেকে উঠে যার যার কাজে বের হয়। আর বাড়ির মহিলারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে গৃহিস্থালি কাজে। এখানে আসলে দিন আর রাতের ব্যবধান শুধু আলো আর আধারের আসা যাওয়া বৈ আর কিছু না। কিন্তু এখানকার লোকগুলো খুব সহজ সরল। আধুনিক সভ্যতার স্যুটেড বুট্যেডদের থেকে এরা আলাদা। পড়নে তাঁতের লুঙ্গি কিংবা ধুতি, পেট পূর্তির জন্য দু বেলা দু মুঠো মোটা ভাত,আর রাত হলে শান্তিমত একটানা ঘুম ছাড়া তারা আর কিছুর আশা করে না। ঘড়ি তো অনেক দূরের কথা! অনেকে কখনো চোখেই দেখেনি এই যন্ত্রটা! তাই সারা গ্রামে দু একজন অতীব বিলাসী শিক্ষিত লোক ছাড়া আর কারো হাতে বা ঘরে সময় দেখার এই যন্ত্র যাকে কিনা ঘড়ি বলে তা নেই। সেখানে এই অজপাড়াগায়ে রাত আটটাই কি আর আর রাত বারোটাই কি! সবই সমান।
যাই হোক ,কুমোর পাড়ার মত এমন পিছিয়ে পড়া পাড়া এ গ্রামে কি ,হয়ত সারা বাঙ্গলাদেশে দু একটি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। পনেরো বিশঘর কুমোর এ পাড়ায় থাকে। সবাই দরিদ্র বা হত দরিদ্র সীমারও নীচে বাস করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মাটির হাড়ি পাতিল তৈরি করে ,রোদে শুকিয়ে ,আগুণে পুড়িয়ে তা বিক্রি করেই এদের জীবিকা চলে। তারপর সেই মাটির হাড়ি পাতিল পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বিক্রি করেই এদের দু বেলা অন্নের ব্যবস্থা হয় । কিন্তু বর্ষাকালে তাদের জীবিকার সে পথটাও রুদ্ধ হয়ে যায় প্রায়।রাস্তা ঘাট ডুবে যায় পানিতে, কাদা,বৃষ্টি ইত্যাদি কারনে বাহিরে বের হওয়াই দায়। তার উপর জেলে নৌকা ভাড়া করে হাড়ি পাতিল বেঁচে খুব একটা পরতায়ও হয় না। তাই বর্ষাকাল মানেই অফুরন্ত অবসর এ পাড়ার কুমোরদের জন্য।তবে এদের মধ্যে দু একজন যারা হাড়ি পাতিলগুলোতে নকশা করতে পাড়ে তারা নিজেদের হাড়ি পাতিল গুলতে সুন্দর সুন্দর নকশা আঁকায় এই অবসরে ।তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলে নিজেদের স্বপ্নকে। আশা করে এ হাড়িগুলোর দাম একটু বেশি হবে।কিন্তু যাদের কোন কাজই থাকে না তারা এসে ভীর করে হীরেনের বাড়ি কিংবা মন্দিরঘরের বারান্দায়। সারাদিন খেয়ে না খেয়ে খুনসুটি,ঝগরাঝাটি আর তামাকের ধোয়া নিতে নিতে কেটে যায় পাড়ার পুরুষদের। আর মহিলারা রান্না বান্না,ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করে করে দিন কাটায়। কিন্তু এত কিছুর পড়েও গোমানীর বুকে স্যালো নৌকার ভটভট আওয়াজ কানে আসতেই মনের সব আনন্দ মাটি হয়ে যায়। ভয়ে চুপসে যায় বাল, বৃদ্ধ বণিতা সবাই।
যাই হোক, যা বলছিলাম। সারাদিন ঝগড়াঝাটি ,মারামারি আর খুনসুটি করে সন্ধ্যা হওয়ার আগ আগ দিয়ে কারো উনুন জ্বলে আবার কারো জ্বলেই না। সন্ধ্যা হতে না হতেই এরা যার যার মত খেয়ে বা না খেয়ে মা দূর্গার মন্দিরে ধূপ জ্বালিয়ে শুয়ে পড়ে। আবার কোন কোন ঘর থেকে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি চলে বেশ রাত পর্যন্ত।তারপর স্ত্রীর চাপা কান্নার শব্দ রাতের আধার কে আরো ভারী করে তোলে আবার কখনো সেই গালাগালি ওখানেই ধপ করে থেমে যায়।
কিন্তু সে যাই হোক, আজ রাতে সারা কুমোর পাড়ায় বোধ হয় ঘুম দেবতার আসীম কৃপা হয়েছে।শ্মশানের মত নিস্তব্ধ হয়ে আছে সব। মাঝে মাঝে শুধু ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে একটানা। আর হীরেনের বাড়ির পেছনের পচা পুকুরের কচুরিপানার উপর দিয়ে হেটে যাওয়া ডাহুকের ডাক, কখনো বাদুরের পাখার ঝাপ্টানি শোনা যাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।এদিকে ঐ বাদুরগুলোর জ্বালায় অবশ্য হীরেনের এটে কলা গাছের কলা গুলো পাকারও সুযোগ পায় না।হীরেন পাল অবশ্য এবার একটা ডুং ডুঙি লাগিয়েছে।একটা ভাঙা টিনের প্লেটের সাথে একটা লোহা দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘরের জানালা দিয়ে ওয়র মাথার কাছে চৌকির পায়ার সাথে বেঁধে রেখেছে। আজও তাই কলা গাছতাতে বাদুর বসতেই ডুং ডাঙ করে ঐ অদ্ভুত জিনিসটা বেজে উঠলো আর ওমনি বাদুরটাও উড়ে গেল।
হীরেনের ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। তার মানে হীরেন এখনো ঘুমায়নি। অবশ্য ওর ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে ঘুমানো খুব শক্ত কাজ। চার মাসের মেয়েটা যখন তখন ঘুম থেকে উঠে পড়ে। হীরেন আর হীরেনের বউ কাঞ্চি তখন মেয়েটাকে নানা ছলা কলা করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তি আর কোন যুক্তিতেই ঘুমাতে চায় না। ফ্যালফ্যাল করে মা বাবার দিকে তাকিয়ে বাপ মায়ের কীর্তিকলাপে ফিকফিক করে হাসতে থাকে।
কাঞ্চিকে দেখিয়ে তখন হীরেন বলে, " দেহো, আমারে মুক্তি কতা শিকে গেছে! ক্যামুন কইরে তাকায়া থাহে দেহো না!"
কাঞ্চি স্বামীর কথা শুনে মুচকি হেসে উত্তর দে, "হ , বাপের মতন ডঙ্গি হইছে" হা হা হা ।
(কন্টিনিউ...)