:::: MENU ::::
  • slider image 1

    Take my hand, take my whole life too.

  • slider image 2

    I never want to live without you

  • slider image 3

    I am who I am because of you.

সোমবার, ১০ জুলাই, ২০২৩

  • ২:১৮:০০ PM

বট বৃক্ষের শেষ কথা
- Sarkar Harun R Roshed


বাবা হাসপাতালে জানার পর কেন জানি আমার ভাল লাগছিলো না। বাবার হাসপাতালে ভর্তির কথা শুনলাম তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা কি পৌনে নয়টা বাজে। আমি আছি দিনাজপুরে। বাড়ি থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরে। দিনাজপুর থেকে বাড়ী যাবার সরাসরি কোন গাড়িও তখন নেই। মা-মামারা চাচারা ফোন করে জানালো বাবার হার্ট এট্যাক হয়েছে। তবে সে এখন স্ট্যাবল। আমাকে তাই পরের দিন সকালে দিনাজপুর থেকে রওনা হওয়ার জন্য বলল। কিন্তু কেন জানি আমার মন বারবার বলতে শুরু করেছে,”হারুন,তোর এখনোই যাওয়া উচিত।“

আমি আমার মনের কথা শুনলাম। রাতের যাত্রাপথের বিভিন্ন হ্যাসেলের কথা ভেবে আমার স্ত্রীকে দিনাজপুরেই রেখে রওয়ানা হলাম। আমার স্ত্রী বারবার আমার সাথে যাবার জন্য রিকোয়েষ্ট করলেও আমি তো জানি এই দীর্ঘ পথের যাত্রা কতটা খারাপ হতে পারে ! তাই ওকে আর সংগে নিলাম না। কোণ মত ব্যাগে একটা কাপড় নিয়ে অফিসকে আমার বাড়ি যাবার এমার্জেন্সি ইনফর্ম করে রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ রওয়ানা হলাম।

দিনাজপুর সদরের কালীতলা থেকে ঢাকার একটা কোচ পেলাম। সেই নাইট কোচে উঠেই সিরাজগঞ্জ রোড পর্যন্ত পৌছানো যাবে। গাড়ী যখন দিনাজপুর থেকে ছাড়লো তখন রাত প্রায় দশটা। জানুয়ারির শেষে হলেও রাস্তায় এখনো ভারী কুয়াশা। চাইলেও খুব বেশি স্পীডে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। এদিকে আমি যখন সিরাজগঞ্জ রোডে(হাটিকুমরুল) পৌছালাম তখন ভোর প্রায় ৪ টা।

সিরাজগঞ্জ রোড থেকে তখন পাবনা যাবার কোন গাড়ি পাচ্ছি না। একটা পত্রিকার গাড়ি দেখলাম প্যাসেঞ্জার উঠাচ্ছে। আমার মত আরো দু একজন ছিলেন যারা বাঘাবাড়ি,পাবনা বা এই রাস্তায় কোথাও যাবার জন্য গাড়ির অপেক্ষা করছিলেন। তাদের সাথে আমিও উঠে পড়লাম সংবাদ পত্র বিতরণ করা সে পিক আপে। এক দিকে তীব্র শীত আর কুয়াশা তার মধ্যে খোলা পিক আপে পত্রিকার উপর বসে যাত্রা করছি আমরা কয়েক যাত্রী।
পিক আপ থেকে বিভিন্ন এজেন্ট পয়েন্ট এ বিভিন্ন পত্রিকার বান্ডিল ফেলে ফেলে দিয়ে যাচ্ছিলেন ড্রাইভার এবং হেলপার। আমাদেরকেও তখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। এদিকে শীতের প্রকোপে আমার অবস্থা খুব বেশি ভাল না। আমার গায়ে শুধুমাত্র একটা শার্ট আর তার উপরে একটা ক্যজুয়াল ব্লেজার। গায়ে শীত না লাগলেও হাত এবং পা আমার ঠান্ডায় হিম হয়ে যাচ্ছে । আর তীব্র কুয়াশায় হাই ওয়ের ৫-১০ মিটারের বেশি দেখা যাচ্ছে না। আর কোথাও কোথাও তো প্রায় অন্যগাড়ির সাথে ধাক্কা না লাগলে বুঝার উপায় নেই সামনে কোন গাড়ি আছে।
এভাবেই হাটিকুমরুল থেকে পাবনা বাস টার্মিনালে যখন পৌছালাম তখন সকাল ৭ টা প্রায়।

সারা রাস্তায় শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি যেন বাবা সুস্থ থাকেন। বাবার সাথে যেন আমার কথা হয়। বাবাকে যেন আমি না হারাই। অবশেষে সাড়ে সাতটা নাগাদ সদর হাসপাতালে পৌছে মা’কে ফোন দিলাম। হাসপাতালে বাবার পাশে ছোট চাচা, আমার মামা আর মা আছেন। আমি সিসিইউ তে ঢুকে বাবাকে দেখলাম ঘুমাচ্ছেন। আমি যাবার সাথে সাথে চোখ খুলে আমাকে বললেন, আমি কখন এলাম। এই রাতের বেলা কেন এত কষ্ট করে আমি এসেছি। সে খুব ভালো আছে। আমাকে চিন্তা করতে বারণ করলেন।

আমি বাবার মেডিক্যাল রিপোর্ট গুলো দেখে বুঝলাম, বাবা নিজের মধ্যে ভাল ফিল করলেও কিংবা মুখে বললেও রিপোর্ট বলছে ভাল নাই। আমি রিপোর্ট টা সংগে সঙ্গে ছবি তুলে আমার ফ্রেন্ড ডাক্তার সোহাগ কে পাঠালাম। সোহাগ আমাকে জানালো রিপোর্ট ভালো না। আর সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে হবে আব্বাকে।আর সিসিইউ তে আরো ৩/৪ দিন রাখতে বলল। যতই ভালো লাগুক কোন ভাবে যেন আগেই কোথাও মুভ না করে। আমিও সে অনুযায়ী বাবাকে বললাম। দশটার পর হাসপাতালের ডাক্তার আসলেন। তিনিও আমাকে একই কথা বললেন। আমি বললাম, বাহিরে কোথাও নিয়ে যেতে পারব কিনা ! ডাক্তার সরাসরি জানালেন, উনি বেডের নীচেও নামবে না। উনারা আরো ৭২ ঘন্টা পর্যবেক্ষন করবেন।

আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে বাবার পাশে বসে আছি। আমার বাবার মধ্যে এখনো আগের মতই দৃঢ়তা। বিন্দু মাত্র ভেঙে পড়া তাকে দেখলাম না। অনেক কথার মধ্যে বাবা আমার জব কেমন চলছে জানতে চাইলেন। পরিশ্রম করতে বললেন। চাকুরীর ক্ষেত্রে সৎ হতে বললেন। সবার সাথে মিলে মিশে কাজের কথা বললেন। তাছাড়া নানা বিষয়ে বাবা একাধারে কথা বলেই চলছেন। এমনকি তার নিজের মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে নিয়ে কোনটার মানে কি তা জানতে চাইলেন। আবার ডাক্তার সরওয়ার মোর্শেদ স্যার মেডিক্যাল টেস্টে যে তাকে ডিসকাউন্ট দিয়েছেন সেটাও বেশ গর্বের সাথে বললেন। আমি মনে মনে বাবার ছেলেমানুষি দেখে হাসলাম। বাবাকে বললাম, টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি তো আছি। আর আপনি যা করেছেন তার তো কিছুই ভোগ করেন নাই। আপনার আমার সব কিছু আপনার চিকিৎসার জন্য আমি ব্যয় করতে রাজি। আল্লাহ তবুও আপনাকে আগে সুস্থ করুক।
বাবা বেশ কনফিডেন্টলি হাসলেন আর বললেন, “তুমিই চলতে পারো না। তুমি আমাকে কি দিবা! হা হা হা। তুমি বলেছ আমি এতেই খুশি। “ আমি নিজের পরাজয় স্বীকার করে নিলাম।

সত্যিই তো আমি আমার এই জীবনে বাবাকে কিছুই দিতে পারিনি। কারণ আমার বাবা কখনো আমার কাছ থেকে কিছু চান নি। ঈদে ঈদে বা কোন কোন সময় কাপড় চোপড় কিংবা বাবাকে কিছুই দেয়া হয়নি। গুণে দেখলে হয়ত সব মিলিয়ে দুইটা গেঞ্জি, ১ টা পাঞ্জাবি আর একটা শীতের কাপড় ছাড়া বাবাকে কিছুই দেই নি আমি। আর গত বছর কুরবানীতে শুধুমাত্র টাকা পাঠিয়েছিলাম গরু কেনার জন্য। আমার বাবার প্রতি এর চেয়ে বেশি আমি কিছুই করিনি। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছে এখন। যখন বাবার কথা মনে হয়, তখন খুব কষ্ট হয় এটা ভেবে যে, জীবিত থাকতে বাবাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি। কিছুই না। শুধুমাত্র তার অসুস্থতাকালীন হাসপাতালের কয়েক হাজার টাকার খরচ ছাড়া আমার আর কোন খরচ হয়নি বাবার জন্য।

যাই হোক, সারাদিন বাবার সাথে নানা কথা বার্তা হলো। তাকে বেশ সুস্থ মনে হলো। দু একবার তো বাবা নিজে থেকেই বললেন, সে হাসপাতাল থেকে বাড়ী চলে যাবে। আমি বুঝিয়ে তাকে নিবৃত করেছি।

সারাদিন বেশ ভালই গেলো। সন্ধ্যার দিকে আমি একটু নীচে গিয়েছি মসজিদে নামাজের জন্য। চাচা নামাজ পড়লেন আমিও বের হয়ে হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাত মা ফোন দিলেন। বলল, বাবা যেন কেমন করছে। আমি দৌড়ে সিসিইউ তে গেলাম। দেখলাম বাবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই বাবা এজমার রুগী ছিলেন ।তার উপর হার্টের রুগী। বাবার শ্বাস কষ্ট হওয়া দেখে আমার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠলো। আমি দৌড়ে ডাক্তারের সাথে দেখা করে ডাক্তারকে ডাকলাম। ডাক্তার এলেন,দেখলেন। অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ডাক্তার অক্সিজেন লাগালেন। মনিটর লাগালেন। এদিকে বাবা ঘেমে যাচ্ছে। আমার মা বাবাকে ধরে কান্না কাটি করছে। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন ।

এদিকে ডাক্তার সহ সকলের ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। বাবার মুখ দিয়ে সাদা ফ্যানা বের হচ্ছে। ডাক্তার জোর করে মা কে সেখান থেকে সরিয়ে নিলেন। বাহিরে বারান্দায় বসালেন মা’কে। আমি তখনো সিসিইউ তে। বারবার মনিটরে বাবার হার্ট রেট, অক্সিজেন লেভেল এর দিকে তাকাচ্ছি। এক সময় দেখলাম বাবার অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে, হার্ট রেট কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেলো। ডাক্তার সিপিআর দিচ্ছেন কিন্তু কোন রেস্পন্স নেই বাবার। চোখের সামনে বাবা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বট বৃক্ষের শেষ পাতাটা ঝড়ে গেলো। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাহিরে মায়ের কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি। আমি জানিনা মা’কে আমি কিভাবে বুঝাবো !

চোখের জল মুছে মায়ের কাছে গিয়ে হাসি মুখে বললাম, আব্বা ভাল আছেন এখন মা। তবে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো। তোমাকে আগে বাড়ি যেতে হবে ,সেখান থেকে জিনিস পত্র গুছিয়ে বাবাকে নিয়ে ঢাকা যাবো। কিন্তু যতই মিথ্যা বলে মা কে ভরসা দিয়ে রাখতে চাই সে আর সম্ভব হয়না। মা আমার ঠিকই বুঝে গেছেন কতবড় ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের পরিবারের। মা কিছুতেই কোন কথা শুনতে চান না। বারবার বলে,”আমি তোর বাবাকে দেখবো। তুই আমাকে তোর বাবার কাছে নিয়ে চল।“
আমি মা কে বাবার সামনে নিয়ে যাবার সাহস পাইনা। বুকের মধ্যে কষ্টের আর্তনাদে পৃথিবীটা ভারী হয়ে আসছে কিন্তু কোন শব্দ বের হচ্ছে না আমার। আমি বাক রুদ্ধ হয়ে গেছি। আমি আমার ছোট মামানীকে বললাম, মা কে নিয়ে বাড়িতে রওয়ানা দিতে। মা কিছুতেই যাবেন না। কিন্তু অনেক কষ্টে মা কে বুঝিয়ে গাড়িতে উঠাতে পারলাম। আর আমি! আমি বাবার মৃতদেহ নিয়ে কোন মুখে মায়ের সামনে দাড়াবো তাই ভাবছিলাম। আমার প্রিয় বাবা। আমার বট বৃক্ষ আজ আমার সামনে নিথর দেহে পড়ে আছেন। আমি কি করবো ! কি করা উচিত! জানিনা।
বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়া হলো না আমার। আমার লক্ষ কোটি ভুল আমার বাবা সয়ে গেছেন। সেই ভুল গুলোর জন্য ক্ষমা চাইবার শেষ সুযোগ টা আমি আর পেলাম না! বাবার হাত ধরে বলা হলো না, “বাবা আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি। অনেক শ্রদ্ধা করি। আমি অনেক ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।“

(Will be continued...)

Writer information NILKANTO