আজ আমি নীরবে মেনে নেই সব। আজ আমি সব পারি, পারতে হয়। এতটুকু প্রতিবাদ নেই কণ্ঠে। নিজস্বতা, স্বাধীনতা বলতে দিন শেষে ঘরে ফিরে এক মুঠো ভাত, ক্লান্ত শরীর, ছটফটানি ঘুম। তবুও ভাল আছি আমি। নিম্ন মধ্যবিত্তের বড় ছেলেদের সব শেষে ভাল থাকতে হয়। একজন সাধারন গৃহিণী নারীর ছা পোষা হাসব্যান্ডকে ভাল থাকতে হয়। মুখে হাসি টেনে বলতে হয়, আমি ভাল আছি। ভাল থাকাটা শিখে গেছি মেনে নেয়ার সাথে সাথে।।
পৃথীবির চিরাচরিত দাসত্বের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি অথবা চেষ্টা করছি মানিয়ে নিতে।
জীবনের ত্রিশটা বছর সুখের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে সুখ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি বুঝতে পারিনি।
একটা সময় ছিল যখন ভর দুপুরে ঘুরি উড়ানোতে সুখ ছিল। সুখ ছিলো ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে ঝাপাঝাপি, বাটুল হাতে সকাল দুপুর পাখি শিকারের প্রাণান্ত শ্রেষ্টায়, কিংবা কাঁচা আমের করালি ঝিনুকের খোলস দিয়ে ছিলে তেল মরিচের ভর্তা, আর পাঁকা আমের নেশায় এ ডাল থেকে ও ডালে ঘুরে বেড়ানো কিংবা ঝড়ের মাঝে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আম কুড়ানোয়।
সুখ ছিল কলার ভেলা বানিয়ে বন্যার পানিতে ভেসে বেড়ানোতে, শৈশবের বন্ধু-বান্ধবীর সাথে ভেন্না তলায় কলার পাতার ঘর বানিয়ে চড়ুইভাতির পাতিলে। সুখ ছিল তিন চাকার বিয়ারিং এর গাড়ি বানিয়ে অথবা সুপারি পাতার খোলসে বসে ধুলো রাস্তায় আগে যাবার প্রতিযোগিতায় । সুখ ছিল, জোসনা রাতে পানি দিয়ে কোর্ট কেটে বদন খেলায় কিংবা ধানের ক্ষেতের আইল ধরে নিরুদ্দেশ হেটে চলায়। সুখ ছিল, মধ্য দুপুরে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতেই মায়ের বকুনিতে, দাদীর আদরে, বাবার শাসনে।
সুখ ছিল, বৃষ্টি হলে হাই স্কুলের বারান্দায় বন্ধুদের আড্ডায়, টিফিনের ফাঁকে ভাল লাগার মানুষটাকে ইশারায় মনের কথা বলাতে। সুখ ছিল, ক্লাসের শেষ ব্রেঞ্চে বন্ধুদের আড্ডায়, কিংবা রাজপথে মিছিলে ছান্দসিক চলাতে।।
সুখ ছিল, ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে রহিম ভাইয়ের দোকানের চায়ের চুমুকে, সারা রাত বন্ধুদের সাথে তাশ আর সিগারেটের আড্ডায়। সুখ ছিল, রাত জেগে মধ্য দুপুরে আড়মোড়া ভাঙতে, পড়ন্ত বিকেলে বান্ধবীর হাত ধরে হাটাতে।
তারপর দিন ফুরালো। সুখ গুলো একে একে ধূসর হতে শুরু করল অজান্তেই। বেকারত্বের অভিশাপ আর স্বাধীনতার অভিলাষকে একসাথে মেটাতে কতই না কিছু করলাম! কিন্তু ওই যে মধ্যবিত্তের শৃঙ্খলে বাধা জীবনে স্বাধীনতা এক আকাশকুসুম স্বপ্ন ছাড়া কিছুনা!
নিত্য নতুন দৈন্যতা, অভাব, অভিযোগ থেকে ধীরে ধীরে একটু সুখের খোঁজে অসুখের বাসা বাধালাম মনে। দাসত্বের শৃঙ্খল বন্দী হওয়ার নেশায় পড়ে হলাম চাকুরীজীবী।
চাকুরী? সে তো স্বাধীনতার বিসর্জন। নিজেকে গলা টিপে হত্যা করে নতুন মানুষ হওয়ার চেষ্টা। আমিও হত্যা করেছি নিজেকে। দিয়েছি প্রবোধ অবুঝ মনটাকে। বলেছি, "এভাবেই মেনে নিতে হয়। মানিয়ে চলতে হবে এভাবেই।"