মেয়েটির নাম "নিশা।"(গল্পঃপার্ট-১)
মেয়েটির সাথে প্রথম পরিচয় ২০০৮/০৯ সালে।তখন ফেসবুক এতটা জনপ্রিয় ছিল না অথবা ফেসবুক সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই ছিল অজ্ঞ। আমার মত কিছু ইন্টারনেট পাগল ছেলে মেয়েরা ছাড়া নেট কি তা অনেকেই জানত না।আর আমরা যারা নেটে যেতাম তারা স্বাভাবিকভাবেই অপরিচিত মানুষের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলাম।
তার উপর চিঠিতে পত্র মিতালী করার এইজটাও গেল গেল প্রায় অবস্থা। সুতরাং প্রযুক্তির ছোয়া বলতে গেলে নেশার মত ছিল আমাদের কাছে। নেশা ছিল নতুন কিছু জানার,নতুন কাউকে জানার,নতুন কিছু করার। তবে আমাদের বয়সী ছেলে মেয়েদের সবচেয়ে আকর্ষনের জায়গা ছিল ফোরাম সাইট গুলো।
আজকে যেমন স্মার্ট ফোনের টাচ প্যাডে ছেলে মেয়েরা সারাক্ষন টুকাটুকি,ঠুকা ঠুকি করে, মেসেঞ্জার,ইমো,হোয়াটস এপ ইত্যাদিতে চ্যাটিং করে,ফ্লাটিং করে,তখন তো আর এগুলো ছিল না তাই মোবাইলের বাটন টিপে মিগ এ কিংবা দেশি কিছু ফোরাম সাইটে আড্ডা মারা,চ্যাট করা ছিল সবচেয়ে বড় নেশা।অনেক সময় দেখা গেছে,টয়লেটের কমোডে বসেও চ্যাটিং করতাম । যাই হোক,তখন যে কটা চ্যাটিং প্লাটফর্ম ছিল তার মধ্যে একটা ওয়েব সাইট ছিল সুমন সেলিম ভাইয়ের ফ্রেন্ডস বিডি.নেট।আরো দু একটার মধ্যে ছিল ফ্রেন্ডস দুনিয়া,আড্ডা খানা ইত্যাদি। এসব সাইটে আমি সাধারত "স্বপ্নবাজ" নামে আইডি ইউজ করতাম। মূলত তখন নতুন নতুন ইন্টারনেট ইউজার আমি।অতএব সাধারণ কৌতুহল বশত কিংবা আর সবার চেয়ে নিজেকে আপডেট রাখার জন্য নেট ছিল আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা বিচরণ ক্ষেত্র।
যাই হোক,
যে মেয়েটির কথা আমি এখন বলতে যাচ্ছি তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল ফ্রেন্ডস বিডি.নেট এ।তারপর বন্ধুত্ব এবং গভীর বন্ধুত্ব।যা আজো কম বেশি টিকে আছে। ফ্রেন্ডস বিডিতে লিংক কিংবা ফোন নাম্বার শেয়ার করা ছিল অপরাধ এবং কেউ ফোন নাম্বার কিংবা ইমেল কিংবা অন্য সাইট লিংক শেয়ার করলে তা স্পাম হিসেবে পরিগনিত হত,কখনো সখনো আইডি সাময়িক বা স্থায়ীভাবে ব্যান করা হত।তাই প্রাইভেট কিংবা পাবলিক যাই হোক না কেন চ্যাটরুমে শুধু চ্যাটিং করা যেত, নাম্বার লেনদেন করতে পারতাম না।বা করার অনুমতি ছিল না।
কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বকে স্থায়ী এবং সুন্দর করার জন্য নাম্বারটা আদান প্রদান ছিল প্রচন্ড রকম জরুরী। আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল দিনদিন। আর যত গাঢ় হচ্ছিল ঠিক ততটাই দুজন দুজনার সাথে কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। তাই যেকোন ভাবেই হোক না কেন ফোন নাম্বার আদান প্রদান করতেই হবে।
তারপর একদিন।
একদিন আমি ওকে কৌশলে আমার নাম্বারটা দিলাম।কৌশল তেমন কিছু না জাষ্ট একটা সংকেত। এই যেমন ধরুন সংকেতটা ছিল এরকমঃ ০agfh fgbffg। ও বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিল।খুব দ্রুত সংকেতের মিনিং করে ফেলেছিল। আমার বিশ্বাস ছিল ও আমাকে ফোন দেবে।কিন্তু কখন আর কোনদিন দেবে তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। নাম্বার দেয়ার পর থেকে একটা অস্থিরতা কাজ করছিল আমার মধ্যে। সারাক্ষণ শুধু এটাই ভাবছিলাম,"কখন সে ফোন দেবে? আর কখন কথা বলব? "
নিজে নিজেই অস্থির হচ্ছিলাম আবার নিজের এই অযাচিত অস্থিরতার জন্য নিজেকেই গাল দিচ্ছিলাম। "আশ্চর্য! আমি কেন এত অস্থির হচ্ছি? ও তো জাস্ট আমার বন্ধু।তাছাড়া তো আর কিছু না! তবে কেন আমি এমন করছি!!! হ্যাভ আই ফলেন ইন লাভ? অর এম আই গোয়িং টু ফল ইন লাভ?"
যাই হোক,এক পর্যায়ে নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হলাম, "ও শুধুই আমার বন্ধু।আর কিছু না।"
নিজের মনকে বোকা বানিয়ে রাখালাম।কিংবা বোকা বানানোর আপ্রাণ চেষ্টায় সম্ভবত সফলই হলাম।কিন্তু তবুও হৃদয়ের কোন এক কোণে ভালবাসার প্রদীপের মিটিমিটি আলো জ্বলে রইলো।কিন্তু পাত্তা দিলাম না।ভয় হলো,যদি ভালবাসাটা আমাদের বন্ধুত্বকে নষ্ট করে দেয়! তাহলে??
এরপর সারাদিন গেল।গোধূলির লাল পশ্চিমের দিগন্তে মিশে আধারের চাদরে পৃথিবী ঢাকলো।কিন্তু ও ফোন করল না। অনলাইনে বার কয়েক গিয়েও দেখা পেলাম না। নিজের মনে নিজেকে বলে উঠলাম,"তবে কি আমি ভুল করলাম? ওকে নাম্বারটা দেয়া কি আমার উচিত হয়েছিল?"
মন একই সাথে ইতিবাচক আর নেতিবাচক উত্তর দিলো।দ্বিধান্বিত মনে নিজের ভুলের জন্য নিজেকে দোষারোপ করলাম।বারবার মনে হতে লাগলো,
"একি করলাম আমি?"
আর যতবার এ কথা মনে হচ্ছিল ঠিক ততটাই চাপা কষ্ট বুকে এসে জমা হলো। ভীত হয়ে গেলাম হারানোর ভয়ে।ওর বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে কিংবা হৃদয়ের কোনে মিটিমিটি ভালবাসার যে প্রদীপ জ্বলছিল তা নিভে যাবার ভয়ে।
এদিকে রাত ক্রমেই গভীর হতে শুরু করেছে।আর সেই সাথে পূর্ব দিগন্তে ছোপ ছোপ মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ উঁকি দিতে শুরু করল যেন।যখনই মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বেড়িয়ে আসে তখনই তার রুপোলী জোসনা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।তারই কিছু কিছু জানালার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নাড়িকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়ে আমার লজ্জাবনত, অপরাধী মুখের উপর।
তারপর রাত ১২ টা নাগাদ একটা অপরিচিত জিপি নাম্বার থেকে ফোন এলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর, "স্বপ্নবাজ? "
আমি বললাম,"হুম।কে বলছেন প্লিজ? "
-"বল,তো কে আমি? "
যদিও আমার মন বলছিল,"এ তো সে! ,যার জন্য তোর মন আজ এতোটা ব্যাকুল।" মনের কথা মনে রেখে বললাম,
-"সরি,আমি আপনাকে চিনতে পারলাম না"।
-"এই,আমি "নিশা "।
-নিশা!
নিশা নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যেন বুকের মধ্যে একটা ভূকম্পন শুরু হলো। এতক্ষন যতটা অস্থির ছিলাম ওর ফোন পাওয়ার জন্য, ঠিক ততটাই নার্ভাস হয়ে গেলাম ফোন পাওয়ার পরে।কি বলব আর কিভাবে বলব, কিছুই যেন মাথায় আসছিল না।এমনকি অনেক গুছিয়ে রাখা কথাগুলোও অগোছালো হয়ে গেল এক নিমেষে। বলতে গেলে আমি বাকশূন্য হয়ে গেছি তখন।
লক্ষ্য করলাম কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে,কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে,হার্ট বিট দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে।
তারপরেও যতটা সম্ভব নিজেকে স্থির করে বললাম,"নিশা! তুমি? "
মিষ্টি হেসে নিশা বলল,"কেন মিস্টার,অন্য কাউকে এক্সপেক্ট করেছিলে নাকি?"
-"আরে না না।ওরকম কিছু না।এই এমনিতেই..."আমি কিছুটা নার্ভাস হয়েই উত্তর দিলাম।
নিশা একটু থেমে মুচকি হেসে বলল,"আরে বাবা বুঝি বুঝি! এক্সপেক্ট করাটা কিন্তু অস্বাভাবিকও না! এত রাত যখন,এক্সপেক্ট করতেই পারো! কর কর,অসুবিধা নেই! "
তারপর একটা অট্টোহাসি , "হা হা হা :)"
নিশার ইঙ্গিত বুঝতে আমার বাকি রইলো না।ওর সাবলীল কথা বলা, মজা করা আর প্রাণ খোলা হাসিতে আমিও হেসে ফেললাম।
আর এই কিছুক্ষণ আগে যতটা নার্ভাস ছিলাম ওর এই একটি কথা আর প্রাণ মাতানো,মন ভুলানো হাসি যেন এক নিমিষে তা মহাজগতের বাহিরে ছুড়ে ফেলল। মনে মনে ভাবলাম,"কারো হাসি এতটা মিষ্টি,এতটা মধুর হতে পারে! আরে ইয়ে তো মুঝে মার ডালা রে,মার ডালা! "
সেদিন পরিচয় পর্ব যেন আবার নতুন করে শুরু হলো।কথায় কথায় ফ্রেন্ডস বিডি থেকে ফ্যামিলি এন্ড ফ্রেন্ডস সব কিছু নিয়ে গল্প করলাম ভোর রাত পর্যন্ত।
আর এই তো ছিল শুরু।
তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিন আমাদের দুরালাপনিতে রাত্রি দিন এক হত।ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গভীর হলো। যদিও আমার মধ্যে ওর প্রতি একটা সুক্ষ্ণ দূর্বলতা ছিল কিন্তু বন্ধুত্বকে অমরত্ব দিতে সেই সুক্ষ্ণ দূর্বলতাকে ভুলে গেলাম।কিন্তু বিশ্বাস করেন,আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে যত আলাপ হত,আমরা একে অপরের যতটা কেয়ার নিতাম আমি হলফ করে বলতে পারি,"কোন প্রেমিক জুটিও পরস্পরের প্রতি এতটা কেয়ারী ছিল না।"
আর এই কেয়ার,ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা,রাতের পর রাত জেগে গল্প করা,জোসনার আলোয় ভিজে ভিজে স্বপ্ন দেখা, কিংবা অমাবস্যার মনখারাপ করা অন্ধকারে হৃদয়ে জমে থাকা মেঘের বৃষ্টি আমাদের দুজন কে অনেক কাছাকাছি এনে দাড় করিয়ে দিল।দুজনার হাজারো সুখ দুঃখকে ভাগাভাগি করে নিলাম দুজন। রাতের পর রাত সুখ গুলো ভাগ করে নিলাম,হাসি ঠাট্টায় মন খারাপের রাত্রিগুলোও মাঝে মাঝে হেসে উঠত আমাদের বন্ধুত্ব দেখে কিংবা বন্ধুত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালবাসা দেখে।
কিন্তু সে ভালবাসার কথা বলা যেত না।কিংবা বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকতে হত শুধু এটা ভেবে যে,যদি আমার কোন আচরণ আমাদের বন্ধুত্বকে নষ্ট করে দেয়!তাহলে??
তাহলে তো ভালবাসার মানুষটার মুখের কথাটা শুনতে পাব না।হয়ত আর কখনোই না। সুতরাং বন্ধুত্বের আড়ালেই না হয় আমার ভালবাসা লুকিয়ে থাক সারাজীবন!
#
এভাবে প্রায় এক বছর কেটে গেল।দেখতে দেখতে সময়টা যে কিভাবে পার হয়ে যায় আসলে বুঝাই যায় না। কিন্তু ফেলে আসা সময়ের দিকে তাকালে আন্দাজ করা যায়,ঠিক কতটা অনুভূতি,কতটা সময় স্মৃতি হয়ে জমা হয়ে গেছে জীবনের খাতায়।বর্তমানে যা ছুয়ে দেখা যায়,সেটাই যখন অতীত তখন স্মৃতি হাতড়ে হয়ত খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু ছুঁয়ে দেখা যায় না। সেটা যে সেখানেই স্থির হয়ে থাকে যেখানে ফেলে আসা হয়।শুধু তার কিছু স্মৃতি অনুভূতিকে টেনে বেড়ায় মস্তিস্কের মেমরি স্লটে।।
আমারো ঠিক একই অবস্থা হয়েছিলো যেদিন নিশা আমাকে তার গল্প বলেছিল। ভয়ংকর, নির্মম,নিষ্ঠুর, লজ্জার সেই গল্প।যা আমার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভালবাসাকে চিরদিনের জন্য বন্ধুত্বের আড়ালে আবদ্ধ করতে বাধ্য করেছিল। শুধু আবদ্ধ করতে পারিনি,যে স্মৃতিগুলো বন্ধুত্বের আড়ালে ভালবাসা হয়ে জমা হয়েছিল দুজনার হৃদয়ে।।
সেদিন ছিলো আষাঢ়ের বৃষ্টিস্নাত এক ঘুটঘুটে আধারের রাত। বাহিরে মষুলধারে বৃষ্টি পরছে।আর এমন এক বৃষ্টি স্নাত রাতে মনটা ভীষণ ভাবে কারো মিষ্টি কথা শোনার জন্য ব্যকুল ছিল।ইতোমধ্যে এতদিনের হাজারো কথা আর অকথার ভীরে নিশার মনে যে আমার প্রতি কি ফিলিংস তা বুঝতে বাকি নেই। আমি জানি সেও আমার মত দ্বিধান্বিত। নানা ছলে সেও অনেক চেষ্টা করেছে তার মনের কথা আমাকে বলতে।কিন্তু আমিই বুঝেও অবুঝ ছিলাম।ভাবছিলাম,কথাটা ওর মুখ থেকেই আগে শুনি না কেন!
কিন্তু তা আর হয়নি।
তাই আজ এরকম এক রাতে আমি পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম নিশাকে লুকিয়ে রাখা মনের কথাটা বলেই ফেলব।আমি জানি,নিশাও আমাকে মনে মনে ভালবাসে। আর সে হয়ত আমার মুখ থেকেই প্রথম কথাটা শুনতে চায়।তাই অনেক ভেবে চিনতে ওকে আজ মনের কথাটা বলবই বলব।এরকমই পণ করেছিলাম। তারপর বেশ রাতে কিছুটা নার্ভাসনেস আর বেশ খানিকটা আশা নিয়ে নিশাকে ফোন দিলাম।
ফোন রিসিভ করেই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,"হাই,কেমন আছো? বৃষ্টি হচ্ছে?? "
-"হুম। অনেক বৃষ্টি।" বেশ খানিকটা উৎফুল্লতা নিয়ে ওকে উত্তর দিলাম।
-"বৃষ্টি আমার ভীষন ভাল লাগে।"
-হ্যা,জানি তো।আর সেই সাথে প্রিয় মানুষ যদি পাশে থাকে ত কথাই নেই! হা হা হা।
-"তা যা বলেছ। আরে এই জন্যেই তো জসীম উদ্দিন লিখেছিলেন,
"আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে,
বেণু বনে বায়ু নাড়ে এলো কেশ,মন যেন চায় কারে! " হা হা হা।
আমি ওর কথায় একটু খোঁচা দিয়ে বললাম,
"তা ম্যাডাম,আপনার কার কথা মনে হচ্ছে, শুনি? "
(চলবে....ফেসবুক পোষ্টঃ ২০ জুলাই ২০১৬)
কপিরাইটঃ নীলকান্ত